মা ও সভ্য পৃথিবীর মায়েরা

                                                             মা ও সভ্য পৃৃথিবীর মায়েরা
                                                          খান মুহাম্মাদ আমিনুল ইসলাম

মা।  একটি মধুর ধ্বনি! হৃদয় বীণায় যে সুর শোনি। কি যে সুখের ব্যঞ্জনা আছে এ অযুগ্ম ধ্বনিতে! কি যে সুধা আছে সে মায়ার আকর, ভালবাসার খনিতে! পৃথিবীর অতুলনীয় একটি নামÑ সে কি মিষ্টি অভিরাম! যে নাম উচ্চারণ করতেই আত্ম-তৃপ্তিতে বুক ভরে ওঠে। মুখে হাসি ফোটে। মাকে ডাকলে যেন বুকে শান্তি পাই। মুখে মজা পাই। হাজারো ক্লান্তি কেটে যায়Ñ সহসা! মা বলে মুখ খোলার সাথে সাথেই যেন হৃদয়ের বদ্ধ দুয়ারও খোলে যায়। দু:খ-বেদনা, কষ্ট-যাতনা, স-ব ভুলে যাই। যে কি সুখ পাই! সে তৃপ্ত অনুভূতি ব্যক্ত করার ভাষা আমার জানা নাই। নওল হাতের দুর্র্র্বল লিখনীর আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলতে আমি একদম নিরুপায়। আনন্দের আতিশয্যে যেন কোথাও হারিয়ে যাই। আমার বিস্তৃত ভাষারাজ যেন মুহূর্তেই ফুরিয়ে যায়। কল্পনার ব্যাপ্ত পরিধিও সংকোচিত হয়ে আসেÑ যার পাশে। থমকে দাঁড়ায় সে নামের শীতল ছায়ায়Ñমগ্ধ আঙ্গিনায়।
মা কথাটি খুব ছোট্ট। কিন্তু তার গভীরতা, ব্যাপকতা আর বিশালতা সুদূর বিস্তৃত। ব্যাপ্ত প্রসারিত। এ ছোট্ট শব্দের গূঢ়ার্থ প্রকাশের ভাষা নেইÑ আসলেই! পৃথিবীর সম বললেও যেন আমার কাছে অত্যল্পই মনে হবে। আরো বাড়িয়ে বললে অত্যুক্তি হবে না বোধ হয় বরং অসমাপ্তই থেকে যাবে। মা এর মাহাত্ম্য, মহানুভবতা মহা সমুদ্রের মতোন? না, তাও না । মনে হয় আরো বেশি।
মা পৃথিবীতে বড় একটি নেয়ামত। প্রভুর বিশেষ অনুগ্রহ, রহমত। এ এক অপূর্ব সওগাত। যার পদতলে আছে অনন্ত সুখের ঠিকানাÑ স্থায়ী জান্নাত। সত্যি! এ নাম উপচে পড়া ভালবাসা ও মায়া-মমতার উন্মুক্ত সরোবর। স্বচ্ছ-প্রস্রবণ। যেখানে অবগাহন করি সর্বক্ষণ। মায়ের ভালবাসা পৃথিবীতে উপমাহীন। নিরুপম মায়ের আদর, স্নেহ-মমতা। মায়ের আদর ভুলবার মত নয়। নিশ্চয়! নিশ্চয়! অবর্ণনীয় তার ভালবাসা। হাসি-আনন্দে, সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে মা সর্বদা সন্তানকে আগলে রাখেন অপার ভালবাসায়। নিজে কষ্ট করেন তবুও খেয়াল রাখেনÑ সন্তান যেন এতসব টের না পায়। সন্তানও সে মায়ের বুকে অনাবিল সুখের ঠিকানা খোঁজে পায়। তাই দূরে গেলে Ñসন্তানের কথা যেমন মা মনে করে, তেমনি মাকেও সন্তানের মনে পড়ে।
মাকে ছেড়ে কোথাও এলে, ভেতরে একটা শূন্যতা অনুভব হয়। বুকে হাত রাখলে মনে হয়Ñ কি যেন নেই। বাড়িতে রেখে এসেছি যেন। কিসের সে অভাব, সবইতো ঠিক আছে! তবুও....। সেটি মায়ের আদর। মায়ের ভালবাসা। তখন অবুঝ মনটা শুধু আনচান করতে থাকে। আর যেন ব্যাকুল হয়ে মাকে ডাকে...। কচি মনটা উন্মুখ হয়ে ওঠে মায়ের দরদ মাখা ডাক শোনতে। সন্তান সর্বদা মায়ের ভালবাসায় সিক্ত তৃপ্ত, পুলকিত-আনন্দিত। অবুঝ দুধের শিশুও মায়ের আদর বুঝে মায়ের মমতা খোঁজে। মায়ের হাতের কোমল পরশ আর উষ্ণতা অনুভব করতে পারে। সে টের পায় হাড়ে হাড়ে। 
মা মানুষের কত প্রিয়! কত কাছের! কত মধুর, মিষ্টি সে ডাক! আমি তো নীরব, নিস্তব্ধ নির্বাক! আশ্চর্য, মা ডাকটি হৃদয়ের গভীর থেকে এমনিতেই উচ্চারিত হয়Ñ কি সুখে, কি দুখে! চলতে ফিরতে প্রতি মুহূর্তে যার কথা মনে পড়েÑ কি কাছে, কি দূরে। দূরে থাকলে তো বারবার মন টানে মায়ের কাছে যেতে। তার আদর আর কোমল হাতের ছোঁয়া পেতে। পিঠে খেতে। বিশেষ করে পৌষের ওশ পড়া শীতে। তখন নিজের অজান্তেই সীমাহীন ভালবাসায় বুক ভরে ওঠে। আনন্দের ফোয়ারা ছুটে। হৃদয়ে খুশির বন্যা বয়ে যায়-মায়ের মমতায়। যদিও মা কাছে নাই।
মায়ের চেহারায় সত্যি জাদু আছে! কি যেন একটা মোহনীয় আকর্ষণ আছে। তাইতো সব সময় মাকে দেখতে ইচ্ছে হয়। এক নিমিষেই মনের বিষণœতা দূর হয়। প্রফুল্লতা, সতেজতা আর প্রাণ চঞ্চলতা খোঁজে পাইÑ তার চেহারায়। তার চেহারায় অবশ্যই একটা কিছু আছে? তা হলোÑ কবুল হজ্বের ছওয়াব। সে এক অফুরন্ত লাভ! মায়ের ডাক শোনলেই সন্তানের কান্না বন্ধ হয়। শত চিৎকার মুহূর্তেই নাই হয়ে যায়Ñ যেন বাতাসে মিলিয়ে যায়। করুণ কান্নাও প্রশমিত হয়। হাজারো দু:খ-বেদনা দূরীভূত হয়।
আমরা পৃথিবীর মুখ দেখেছিÑ মা-বাবার বদৌলতে। সুতরাং মা-বাবার মর্যাদা সবচেয়ে বেশি। তাইতো আমাদের প্রভু, আল্লাহ বলেছেন- তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করতে, বিনয়াবনত হতে বলেছেন। তাদের জন্য দোয়া করতেও  শিখেয়েছেনÑ খুব চমৎকার ভাষায়! তাদেরকে সামান্যতম কষ্ট দেওয়া তো দূরের কথা বরং এমন আচরণ করতেও নিষেধ করেছেন; যে কারণে তারা ‘উফ’ শব্দ উচ্চারণ করে ফেলে! তবুুও মায়ের মর্যাদা বেশি। কেননা, রাসূল (সা.) এর নিকট এক সাহবী এসে বললÑ আমি খেদমত করব কার? রাসূল (সা.) বললেন, তোমার মার। এভাবে তিনবার বললেন, চতুর্থবার বললেন তোমার বাবার। হ্যাঁ, তবে বাবার মর্যাদাও কিন্তু কম নয়। সে কথা ভুলে গেলে চলবে না। বাবার হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের কথা কি তুমি বলবে না?
তাছাড়া মা নিজের জীবনকে মাটি করেনÑ সন্তানের জন্য। সন্তান লালনে মা শীত-গ্রীষ্ম, রোদ-বৃষ্টি সব কিছুই যেন উপেক্ষা করেন। সব কষ্ট সয়ে যান অম্লান বদনেÑ হাসি মুখে। শুধু সন্তানের জন্য এতসব। যদিও তার কত আশার আলো আজো নিষ্প্রভ। কত কষ্ট সহ্য করে মা সন্তানকে দীর্ঘদিন গর্ভে ধারন করে রাখেন। আর প্রসব বেদরায় মা যেন কাতর হয়ে যান। যেন ওষ্ঠাগত হয় মায়ের প্রাণ। কখনো প্রাণ বায়ু বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। এভাবে অনেক মা সন্তানের আশায় নিজের জীবন হারান। নিজের জীবনের দিকে না তাকিয়ে সন্তানের মুখ দেখতে চান। সন্তানের মুখ দেখে মা সব কষ্ট ভুলে যায়। মায়ের মানিক বুকে তুলে নেয়, মুখে চুমু খায়। তিল তিল করে মা সন্তানকে বড় করে তোলেÑ সে কথা কি গেছি ভুলে? না।
তখন আমরা মাকে কত কষ্ট-ই না দিয়েছি! সে মায়ের মূল্য দিতে পারব? আর দুধের ঋণ শোধ করতে পারব? না, কিছুতেই না। নিজে কত না খেয়ে আদুরে সন্তানকে খাওয়ান! আসলে পৃথিবীর সব মা-ই সন্তানকে খাইয়ে আনন্দ পান। আমি চোখে পানি ধরে রাখতে পারি নাÑ অশ্রুতে ভেসে যায় মায়ের এসব কষ্টের কথা মনে হলে! তবুও মানুষ কিভাবে সে মাকে ভুলে ! নিজে থাকে এসি রুমে, মাকে রাখে বৃদ্ধাশ্রমে। হায় বিবেক! হায় মানবাতা! ওরা কেমন সন্তান Ñমাকে মাথার বোঝা মনে করে! ওরাই আবার সভ্যতার দাবীদার! অধিকারের ফেরিওয়ালা বঞ্চিত মানবতার! মা তো মা-ই। তার মত আর কেউ হয় না। মা আদর-সোহাগ, স্নেœহ-মমতার যে পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন সন্তানের প্রতি, পৃথিবীর আর কেউ কি তার উপমা বা অনুরূপ হতে পারে? নাহ! কস্মিনকালেও না। তাই মা অদ্বিতীয়, অনন্য, অতুলনীয়!

কিন্তু আমার আক্ষেপ শত আফসোস! সভ্য পৃথিবীর কিছু মায়ের প্রতি। ওরা সন্তান চায় না। চায় অন্য কিছু। ছুটে তার পিছু। ওরা যেন নষ্ট চিন্তা আর হীন স্বার্থ খোঁজতে যায়Ñ পরকিয়ায় মজতে চায়। পঙ্কিলতায় ডুবে যায়। বেপরোয়া ওসব মায়ের সন্তানের প্রতি কোন মায়া নাই। ওসব ঘৃণ্য মায়ের কাছে সন্তানরা আজ নিরাপদ নয়।ফলে যা হবার তাই হয়। কি জঘন্য কি হিংস্র! কি পাষন্ড ওসব মা! পরকিয়া বা প্রেম কাতর ও সব মা নিজ হাতে সন্তানকে হত্যা করে ফেলে।  পত্রিকার পাতা আর সংবাদ মাধ্যম গুলোতে যার অহরহ প্রমাণ মেলে। জাতীর বিবেকের ভীত নাড়িয়ে তুলে! মিডিয়া পাড়ায় শোকের মাতম শোনা যায়। এসবের নিমিত্ত আর রহস্য উদঘাটনে যেন প্রশাসনও হিমসিম খায়। কত নির্মম , নিষ্ঠুর, পাষান-পাথুরে ওদের অন্তর! আশ্চর্য, ভাবতেও অবাক লাগে Ñমা সন্তানকে হত্যা করে ! কিছু মা সন্তান নেওয়া বা সন্তান লালন এক প্রকারের উটকো ঝামেলাই মনে করে। ওরা নিষ্পাপ প্রাণগুলোকে পৃথিবীর মুখই দেখতে দেয় না। অন্ত:সত্ত্বা হওয়া তো পরের কথা বরং পেটে শিশুর স্থিতি লাভ করার আগেই প্রাণে মেরে ফেলেÑচিরতরে। অনেকেই ভ্রƒণ হত্যা করে । আরো বিভিন্ন্ভাবে জন্ম নিরোধ পদ্ধতিগ্রহণ করে সভ্য পৃথিবীর মায়েরা। কি নিষ্ঠুরতা! কি বর্বরতা! এ যেন জাহেলী যুগকেও হার মানবে। ওসব মায়ের প্রতি ধিক শতধিক!ওরা সন্তান ছাড়া মুক্তবিহঙ্গের মত ঘুরে বেড়াতে চায় দিগবিদিক! ওরা সন্তানকে সন্তান বলে পরিচয় দিতে লজ্জা পায় যেন। কোন অনুষ্ঠান বা সেমিনারে গেলে, মা মেয়েকে বলে দেয়Ñতুমি আমাকে মা বলে ডাকবে না, তাহলে কিন্তু ইজ্জত থাকবে না। আমার সাজ-সজ্জা, ভাব-ভঙ্গিমা সব মাটি করবে। আমার ভাবের উত্তাল তরঙ্গেও ভাটা পড়বে। সুতরাং দোহাই মেয়ে Ñতুমি আমাকে মা বলে ডেকো না। বিস্ময়, মহা বিস্ময়! এমন মাও সভ্য  পৃথিবীতে বাস করে! তাই মা মেয়ে একই রঙের একই ডিজাইনের আঁটোসাঁটো নগ্ন পোষাক পরিধান করে। ডিজিটালের দূষিত হাওয়ায় বেড়ায় ঘুরে .....। পরবর্তীতে ওরা আধুনিকতার সেই পঙ্কিল স্রোতে ডুবে-পচে মরে। তবে ওসব মায়ের গোষ্ঠী কখনো চিন্তা করেনা, কল্পনাতেও আনে না যে, “আমার মাও যদি জন্ম নিরোধের পন্থা অবলম্বন করতেন; তাহলে আমিও তো পৃথিবীর মুখ দেখতে পেতাম না’’। ওরা সন্তানকে স্তন্য দান করে না। তেমন সময়ও দেয় না বরং সন্তান লালন করে অন্যের কোলে। তাই মায়ের ¯েœহ বঞ্চিত শিশুরা ভিন্নভাবে যেন বেড়ে ওঠে। এভাবে অনেকে অসামাজিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হযে পড়ে ঐ শিশুরাই এক সময় খুন, গুম ও সন্ত্রাসের স"ষ্টি করে।
আর সমাজ পরিবর্তনে মায়ের বলিষ্ঠ ভূমিকা আছে অবশ্যই। সে কথা তো অবলীলায়, নির্দ্বিধায় স্বীকার করতে হয়। ইতিবাচক নেতিবাচক উভয় দিকই লক্ষ্য করার মত । কিছু সভ্য মায়ের নেতিবাচক প্রভাব দেখে আমি প্রায় বিব্রত। নেতিবাচক প্রভাবই লক্ষ্য করা যায়, ওসব সভ্য পৃথিবীর আধুনিক মায়ের চলাফেরায় । যার ফলশ্রুতিতে চরম অবক্ষয়ের ধ্বস নামছেÑ যুব সমাজের নীতি-নৈতিকতায়। আজকে যারা আধুনিকতার উত্তাল ¯্রােতে ভাসমান। আধুনিকায়নে আর মত্ত মাতাল হতে চান। ওরা কারা? কলেজ-ভার্সিটিতে, পার্কের বেঞ্চিতে বিভিন্ন চত্ত্বরে , ব্রিজের নিচে উপরে, ঝিলের পাড়ে, থিয়েটারে আড্ডা দেয় সেসব মেয়ে বা মায়েরা। নোংরামী আর নষ্ট সঙ্গ দিতে মাতোয়ারা , যেকোন সুস্থ চিন্তার অধিকারী বা মার্জিত রুচিবোধ সম্পন্ন ব্যক্তি ওদের ঘৃণ্য কর্মকান্ড দেখে লজ্জায় মাথানত করে দ্রুত রাস্তা মাপে। খুব কষ্টে দিন কাটে সে পাপের অনুতাপে! কিন্তু ওদের চোখে মুখে ইতস্ততা বা লজ্জাবোধের কোন রেখাপাতও নাই। কত মানুষ যে লজ্জায় চোখ তুলে ওদের দিকে তাকাচ্ছেও নাÑসেদিকে কোন পরওয়া নাই। ওরাও একদিন মা হবে, সভ্য পৃথিবীর নষ্ট জননী হবে। সভ্য পৃথিবীর ওসব অসভ্য মায়ের দ্বারা কি সমাজে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে? সে কথা কি কেউ স্বপ্নে চিন্তা করবে? নাহ! তা তো কখনই না। পরিশেষে আমার আন্তার আকুতি হলোÑ হে মা শোন, পৃথিবীর ভারসাম্য টিকিয়ে রাখতে হলে, পৃথিবীকে আরো কিছুদিন আবাসযোগ্য দেখতে হলে; অবশ্যই তোমাকে পরিশুদ্ধ হতে হবে। বলো, আর কতকাল পাপের মহড়ায় উন্মত্ত হয়ে গ্লানিময় জীবন যাপন করবে! তোমার বর্তমান জীবন ধারায় যদি আমূল পরিবর্তন আনতে পারো; তাহলে আধুনিক সভ্যতার এ পৃথিবীও তার রূপ বদলাবে। পাপের সমূহ আবিলতা কেটে যাবে। আগামীর পৃথিবী পূণ্যের সন্ধান পাবে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কোরবানীর আভিধানিক ও পারিভাষিক সংজ্ঞা, কোরবানীর সূচনা।

হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল রাঃ এর জীবনী

মাইক্রোসফট ওয়ার্ড শিখুন।