হজ্জের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
মিনহাজ উদ্দীন।।
পারম্ভিকাঃ হজ্জ ইসলামের পাঁচটি ভিত্তির অন্যতম ভিত্তি। হজ্জ এর আভিধানিক অথ হচ্ছে সংকল্প করা।
পারিভাষিক অর্থে নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত পদ্ধতিতে বায়তুল্লাহ শরীফ ও সংশ্লিষ্ট স্থানসমূহ জিয়ারত ও বিশেষ কার্যাদি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে কাজ সম্পাদন করাকে হজ্জ বলে। হজ্জের রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস ও দীর্ঘ পটভূমি। এর প্রতিটি কাজ ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত ও তাৎপর্য।
হজ্জের গুরুত্ব ও তাৎপর্যঃ আল্লাহতায়ালা হাকীম ও প্রজ্ঞাময়। তার কোন কাজই হিকমত ও রহস্য থেকে খালি নয়। ইসলামি মুসাফিরগণ হজ্জের হাকীকত ও তাৎপর্য্ সম্পর্কে অনেক দিকনির্দেশনা পেশ করেছেন। নিম্নে হজ্জের গুরুত্ব ও তাৎপর্যসমূহরে উপর আলোকপাত করা হলোঃ
১। হজ্জ ফরজ ইবাদতঃ হজ্জ ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের একটি বিশেষ স্তম্ভ। এর ফজিলত অকাট্য দলিলের ভিত্তিতে প্রমাণিত। এর ফজিলত অস্বীকার করা কুফরী। সামর্থবান ব্যক্তির জন্য জীবনে একবার হজ্জ করা ফরজ। বিশুদ্ধমতে হজ্জ ফরজ হওয়ার পর বিলম্ব না করে আদায় করা অবশ্য কর্তব্য। হজ্জ হচ্ছে এমন ইবাদত যা সম্পাদন করতে জান ও মাল উভয়েরই প্রয়োজন হয়। হাদিসে হজ্জের ফজিলতের কথা বিশদৃভাবে বিবৃত হয়েছে।
২। আখেরাতের সফরের নিদর্শনঃ মুহাক্কিক আলিমগণ হজ্জের সফরকে আখেরাতের সফরের সাথে তুলনা করেছেন। কেননা মানুষ যখন হজ্জের উদ্দেশে বের হয়, তখন আত্মীয়স্বজন বাড়িঘর, বন্ধুবান্ধব ত্যাগ করে তারা যেন পরকালের সফরে বের হয়। সাফা মারওয়ায় সাঈ হাসরের ময়দানে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করার সমতুল্য। সেদিন যেমন মানুষ দিশেহারা হয়ে নবী-রাসূলদের নিকট দৌড়াদৌড়ি করে থাকে। আরাফার ময়দানে লক্ষ লক্ষ মানুষের অবস্থানে হাশরের সমদানের নমুনা বলে ধরা হয়। সূর্যের প্রচণ্ড তাপের মধ্যে আশা ও ভয়ের এক করুণ দৃশ্যের অবতারণা হয় এ ময়দান। এককথায়, হজ্জের প্রতিটি আমল থেকেই আখেরাতের সফরের কথা ভেসে উঠে হজ্জযাত্রীর মনে। এটাই হলো হজ্জের প্রধানতম তাৎপর্য ও রহস্য।
৩। ইশক ও মহব্বতের প্রকাশঃ হজ্জ হলো আল্লাহর ইশক ও মহব্বত প্রকাশ করার এক অপরূপ বিধান। অর্থাৎ প্রেমাষ্পদের আকর্ষণে মাতোয়ারা হয়ে প্রেমিক ছুটে চলে বায়তুল্লাহর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে। হজ্জের প্রতিটি আমলেই আমরা দেখতে পাই প্রেমের প্রকৃষ্ট নিরর্শণ। কেননা বন্ধুবান্ধব, বাড়িঘর ও আত্মীয়স্বজনেরর মায়া ত্যাগ করে প্রেমাষ্পদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়া এবং তারই তালাশে বনজঙ্গল, পাহাড় পর্বত ও সাগর মহাসাগর পাড়ি দিয়ে পবিত্র মক্কা ও মদিনার অলিতে গলিতে ছুটাছুটি করা একমাত্র প্রেমিকেরই কাজ।
৪। প্রকৃত প্রেমিকের নিদর্শনঃ ইহরাম বাঁধা প্রকৃত প্রেমিক হওয়ার এক জ্বলন্ত নিদর্শন। না আছে মাথায় টুপি, না শরীরের জামা, না সুন্দর পোশাক, না আছে সুগন্ধী এবং ফকিরবেশী সদা চঞ্চল ও উদাসীন মনের সেলাইবিহীন শ্বেত ও শুভ্র কাপড়ের আচ্ছাদিত মুহরিমের সে কি এক অপূর্ব দৃশ্য। লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক বলতে বলতে ছুটে চলছে। এমনিভাবে হাজরে আসওয়াদ চুমু খাওয়া, মুলতাযাম জড়িয়ে ধরা, কাবার চৌকাঠ ধরে কান্নাকাটি করা এবং মধু মক্ষিকারা মতো বায়তুল্লাহ শরীফের চারিদিকে প্রদক্ষিণ করা সকলই ইশকে ইলাহীর অনুপম দৃশ্য।
৫। চরম ও পরম মঞ্জিল: প্রেম ও ভালোবাসার চরম বিকাশ ঘটে জামারাতে কঙ্কর নিক্ষেপ করার সময়। কেননা প্রেমিকের আবেগ যখন চরমে পৌছে তখন প্রেমাষ্পদকে লাভ করার পথে যেই বাঁধা হয় তাকেই সে এলোপাথাড়ি পাথর নিক্ষেপ করে। অনুরূপভাবে, জামারাতে এসে হাজীরা তাই করে থাকে। এর পর পশু কুরবানি করে প্রেমানুরাগের শেষ মঞ্জিল অতিক্রম করে নবজাতক শিশুর ন্যায় নিষ্পাপ অবস্থায় ফিরে আসে হাজীরা স্বীয় মুসাফিরখানায়।
৬। বিশ্বভ্রাতৃত্বের উন্মেষ: বিভিন্ন দেশ হতে আগত হজ্জযাত্রীদের শারীরিক কাঠামো ভিন্ন, ভাষা ভিন্ন, কিন্তু মীকাতের নিকট এসে তারা নিজেদের পোশাক খুলে একই ধরনের পোশাক পরিধান করে। তখন তাদের মধ্যে একই ইলাহ এর বান্দা হওয়ার চিহ্ন পরিলক্ষিত হয়। সকলের মুখে একই ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তোলে। তারপর মক্কা ও মদিনার পবিত্র ভূমিতে কাফেলা একত্রিত হয় এবং সকলে একই পদ্ধতিতে একই ইমামের পিছনে সালাত আদায় করে। এভাবে সমবেত মুসলিম জনতা ভাষা, জাতি, দেশ ও গোত্রের কৃত্রিম বৈশিষ্ট ভেঙ্গে দিয়ে বিশ্বভ্রাতৃত্ব স্থাপনের বিরাট সুযোগ পায়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন