কুরবানী: চেতনা ও তাৎপর্য।


 হাফেজ মিনহাজ উদ্দীন
আস্সালামু আলাইকুম। আশার করি সকলেই আল্লাহর রহমতের ভালো ভাবে দিন গুজরান করছেন। বন্ধুরা আজকে আমি ‘কুরবানী: চেতনা ও তাৎপর্য’ বিষয়ে লিখবো আশা করি আপনারা উপকৃত হবেন।
এ বিষয়ে পড়ার আগে প্রথমেই আমাদের জানা উচিত কুরবানী কি?
 ‘কুরবানী’ একটি আরবী শব্দ। যার আভিধানিক অর্থ ত্যাগ করা, উৎসর্গ , বিসর্জন নৈকট্যলাভ ইত্যাদি। ইসলামের পরিভাষায়  যিলহজ্জ মাসের দশ তারিখ থেকে বারো তারিখ পর্যন্ত সময়ের পরিসরে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে বিশেষ কিছু পশু জবাইকে কুরবানী বলা হয়। আর এ উপলক্ষে পালিত উৎসবকেই আমরা বলি ঈদুল-আযহা বা কুরবানীর ঈদ।
 বন্ধুরা পবিত্র ঈদ ও কুরবানী সম্পর্কে প্রিয় নবী সা: ইরশাদ করেন,
 ما عمل اُد مي من عمل يو ا نحر احب الي الله من اهراق الد
  কুরবানীর ঈদের দিবসে আল্লাহ তাআলার কাছে মানব সন্তানের সর্বাধিক প্রিয় আমল হলো পশু জবাই । মনে রেখ, কিয়ামত দিবসে কুরবানীর পশুটি তার শিং, লোম এবং হাড় সমেত উপস্থিত হবে এবং কুরবানীর রক্ত মাটি ষ্পর্শ করার পূর্বেই তা আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয়ে যাবে। সুতরাং তোমরা তৃপ্ত মনে কুরবানী কর। একজন কল্যাণকামী বিশ্বাসী ও অবিনশ্বর বেহেশতপ্রার্থী বান্দার জন্যে প্রিয় নবীজির এই আহবানই যথেষ্ট- সামর্থের সমস্ত সম্পদ উজাড় করে খুশি মনে কুরবানীর প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্যে। অধিকন্তু এই কুরবানীর উৎস এমন এক প্রাণময় প্রেমময় অবিষ্মরণীয় ঘটনা যা যে কোন ভক্ত বিশ্বাসী মুমিনের হৃদয়ে জাগায় প্রেমের তুফান, ভাবের তরঙ্গ। কেননা আজ আমরা পশু কুরবানীর মাধ্যমে যে ঈদ উৎসব পালন করি এর উৎস হলো সায়্যিদুনা হযরত ইবরাহীম আ: এর স্বপ্নে আদিষ্ট হলেন আল্লাহর নামে কুরবানী দিতে হবে প্রানপ্রিয় দুলাল কলজেছেঁচা ধন কিশোরপুত্র ইসমাইলকে। অথচ এই সেই ইসমাইল , যাকে পুত্র করে পেতে কত রজনী কাদতে হয়েছে খলিলুল্লাহকে।যৌবনের আলোকিত সবুজ প্রাঙ্গণ অতিক্রান্ত করে বার্ধক্যের ধূসর ময়দানে সদাভ্রাম্যমাণ নবী ইবরাহীমের মনে যখন কুদরতের অসীমত্ব তরঙ্গময় হয়ে উঠল- এত চিরমানবিক ব্যথাময় প্রার্থনা তখন বাঙময় হয়ে উঠল তদীয় নববী কণ্ঠে। বলে উঠলেন, রাব্বি হাবলি মিনাস সালিহীন- হে আল্লাহ! আমকে একটি নেকপুত্র দাও।
 প্রিয় পাঠক!
শরীরের সর্বত্র বার্ধক্যের ধবল রৌশনীর দাপট চললেও ইবরাহীম আ: এর মনে ছিল আল্লাহর রহমত, শক্তি ও অভিপ্রায়ের শক্তিমান উপস্থিতি। তাই তাঁর দীর্ঘজীবনের সন্তানহীন হাহাকারের ইতি চাইলেন। মনিবও নিরাশ করলেন না তার প্রিয় বান্দার মনোবাঞ্চনাকে। বরং বলে দিলেন, ‘ আমি তাঁকে ধের্যশীল সন্তানের শুভ সংবাদ দিলাম।’ অতঃপর জীবনের অন্তীমলগ্নে এসে প্রাপ্ত এই হৃদয়ের ধন যখন শৈশব কৈশোরের মমতাময় আবেদন নিয়ে হাজির হলো, নবী ইবরাহীম আ: এর জীবনে পিতৃত্বের সমূহ অনুভূতিকে রসে-গন্ধে করে তুলল সতেজ ও পরিপূর্ণ; সন্তানের প্রতি জনকসূলভ দরদে ভরে উঠল যখন হৃদয়- মন, বিশ্বাস, অনুভব; অনুমান ঝুঁকে পড়র যখন সোহাগভেজা নন্দনের প্রতি তখনই নির্দেশ এলো আমার নামে প্রিয় পুত্রকে কুরবানী দাও।
বড়ই তাৎপর্যময় এই আদেশ! জীবনের সন্ধাবেলা বহু অনুনয়, অনুরোধ, কান্নাকাটি, আহাজারী পর প্রাপ্ত সন্তান, বুড়ো জীবনের একমাত্র সঞ্চয়; তাও পিতা হয়ে আপন হাতে কলিজার টুকরা ইসমাইল জবাই দিতে হবে। পৃথিবীর যে কোন হৃদয়বান পিতার পক্ষে এটা কি সম্ভব? অধিকন্তু সেই আদেশ এলো স্বপ্নযোগে। হযরত ইবরাহীম স্বপ্ন বলে বিষয়টি সহজভাবে নিতে পারতেন। কিন্তু হযরত ইবরাহীম আ: তো আল্লাহর খলিফা! প্রি দুস্ত! তাই ইবরাহীম আ: এর বুঝতে কষ্ট হয়নি- মূলত বন্ধু চাচ্ছেন আমার অন্তরে শুধুই তাঁর ভালোবাসা ছাড়া যেন আর কারও স্থান না হয়। তা্ই তিনি সঙ্গে সঙ্গেই সাড়া দিলেন বন্ধুর ডাকে। সিদ্ধান্ত নিলেন, বন্ধুর আদেশ পালনে কলিজার টুকরাকে বলি দিতে আপত্তি নেই তার। কিন্তু ইসমাইল সেকি মেনে নিবে ! কোন সন্তানকি চাবে সে জবেই হোক, আমাদের সমাজে বলা হলে কি বলতাম ! তোমার মরার সাধ জাগছে তুমি মর, আমি মরবো কেন? ইসমাইল কে জানানো হলো আল্রাহর নামে তোমাকে জবেহ করবো এতে কি তোমার কোন আপত্তি আছে? স্বপ্নের আদেশ শুনে আবেগমথিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, আব্বু আপনাকে যে আদেশ দেওয়া হয়েছে আপনি তা পালন করুন,  নিশ্চয় আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন- ইনশাআল্লাহ! অতঃপর নিজ হাতে ছুড়ি চালালেন আপন সন্তানের গলাই। পিতা-পুত্রের এই বিস্ময়কার অপূর্ব অশ্রুত মহিমান্বিত ত্যাগ ও বিসর্জনকে কবুল করে নিলেন আল্লাহ। বেহেশত থেকে দুম্বা পাঠিয়ে ইসমাইলের স্থলে কুরবানী করলেন আর পিতা-পুত্রের এই অসীম অসামান্য ত্যাগের আদর্শকে সমুন্নত, শাশ্বত ও উন্নত  করে রাখার লক্ষে শ্রেষ্ঠ উম্মত- উম্মতে মুহাম্মাদী ধর্মীয় চিরন্তন কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত করে দিলেন মহান রাব্বুল আলামীন। একথাই ইরশাদ করেছেন প্রিয়তম নবী সা: সাহাবায়ে কিরাম আরয করলেন: হে রাসূল ! এই পশু জবাই এই কুরবানীগুলো কেন? প্রিয় নবীজী সা: উত্তর দিলেন, তোমাদের পিতা হযরত ইবরাহীম আ: এর আদর্শ। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, এতে আমাদের কী লাভ? রাসূল সা: উত্তর দিলেন, প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি। (মুসনাদে আহমাদ)
এই হাদিসের আলোকে খুব সহজ করেই বলতে পারি, কুরবানীর ফলাফল খুবই সরল এবং ষ্পষ্ট। বান্দা যে পশুটি কুরবানী দেবে তার প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে পূণ্য। সহজ কথা নয়। এক রকমের বিস্ময়কর প্রতিদান।
কিন্তু এর রহস্য কি? কেন স্থল- ক্ষুদ্র একটি ইবাদতের বিনিময়ে এত বিশাল পুরষ্কার ব্যবস্থা।
অবশ্য আমরা যদি তুরবানীর উৎসমূলের একটু গভীরে প্রবেশ করি তাহলেই উপলব্ধি করতে পারব এর নিগূঢ় তত্ত্ব, গভীর মর্ম। মূলত আমরা আজ বিশেষ দিনে মহান মালিকের নামে যে কুরবানী করি এটা স্থলদৃষ্টিতে সাধারণ পশু জবাই হলেও এটা কিন্তু প্রকৃতঅর্থে আপন প্রত্র বিসর্জনের স্থলাভিষিক্ত। শুধুই পুত্র বিসর্জন নয়, বরং নবী ইবরাহীম আ: এর গভীর ইলাহীপ্রেম আর কিশোর ইসমাইল আ: এর আল্লাহর আদেশের প্রতি নিঃশর্ত জীবনদানের অপূর্ব সমন্বিত ত্যাগের প্রতিদান এই সাধারণ পুরষ্কার। তাই এই অসাধারণ প্রতিদান লাভ করতে হলে দুনিয়ার এই পশু কুরবানীর মধ্যেও থাকতে হবে সেই ইবরাহীমী চেতনার পরশ; ইসমাইলী ত্যাগের সুবাস। পবিত্র কুরআনে যে চেতনার বিবরণ উদ্ধৃত হয়েছে এই ভাষায়,
قل ان صلا ثي ونسكي و مما ثي لله رب ا لعلمين
বলুন, আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ সবই বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহ জন্য।
মূলত একজন মুমিন বান্দা যদি আত্মিক এই আলৌকিক চেতনা ও বিশ্বাসের সাথে একটি সাধারণ ছোট্র প্রাণীও কুরবানী করে, বিশ্বাস চেতনা ও আবেগের শানে এই সামান্য পশু কুরবানীও আল্লাহর দরবারে ইবরাহীমী ত্যাগের ফসল বয়ে আনবে।
প্রেম ও আনুগত্যভরা এই আন্তরিক নিবেদনই তাকওয়া; আর  এই তাকয়াই তো কুরবানীর মূল প্রার্থণীয় বিষয়। ইরশাদ হচ্ছে, لن ينا ل ا لله لحو مها ولا دما ءها و لمكن ينا له ا لثقوي منكم
এই জবাইকৃত পশুর রক্ত মাংস আল্লাহর দরবারে পৌছায় না। তাঁর দরবারে পৌছায় তোমাদের তাকওয়া।
মূলত মহান মনিবের প্রতি এই নিঃশর্ত সমর্পন আর আনুগত্যের বিভাময় লক্ষ্যেই আরও
 ইরশাদ হয়েছে যে, فصل لربك  ونحر
সুতরাং নামায পড় তোমার প্রভুর তরে এবং কুরবানী কর।
করুণাময়ের দরবারে ইবরাহীমী ত্যাগের ফসল বয়ে আনে বান্দার জীবনে। সন্দেহ নেই, এ কেবল তাঁর অসীম অনুগ্রহমাত্র। কিন্তু আজ আমরা যারা শুধু নিজেদের বিত্তের অহংকার আর নিজেদের বড়লোকী ফোটানোর হীন উদ্দেশ্যে উচ্চ দামের পশু জবাই করি তাতে কি সেই ইবরাহীমীপ্রেম আর ইসমাইলী ত্যাগের সামান্যতম সম্পর্ক আছে? যদি না থাকে তাহলে কিসের ভরসায় আমরা এত বিশাল প্রতিদানের আশায় বুক বাঁধব। অতএব, সময় থাকতেই কুরবানীর পশু জবাই করার পূর্বেই আমাদের বিশ্বাস ও চিন্তাকে আলোকিত করে তুলতে হবে ইবরাহীমীপ্রেমের আর ইসমাইলী ত্যাগের বিভায়। তবেই ফলবান ও তাৎপর্যময় হয়ে উঠবে পবিত্র ঈদ উৎসব আমাদের জীবনে।
বলাবাহুল্য, যখনই আমরা একান্তই আল্লাহর প্রেমে শুধু তাঁরই নামে তাঁরই সন্তুষ্টির লক্ষ্যে ‍কুরবানী করতে পারব, তখনই বস্তুতান্ত্রিক সকল স্থল অহংকার জয় করতে পারব আর মিশে যেতে পারব আল্লাহর সকল বান্দার সাথে একই মালিকের বান্দা হিসেবে; একই প্রভুর প্রেমপিয়াসী হিসেবে। অনন্তর তখনই কুরবানীর ঈদ-উৎসব প্রকৃত ঈদ আনন্দ আর সম্প্রীতি বয়ে আনবে আমাদের সমাজ জীবনের সকল প্রাঙ্গণে। বিশৃঙ্খলাক্লান্ত এই পৃথিবীর জন্যে আজ যা সকলেরই কাম্য।
আল্রাহ আমাদেরকে সেই তাওফীক দান করুন। আমীন।

ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না। আমার 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কোরবানীর আভিধানিক ও পারিভাষিক সংজ্ঞা, কোরবানীর সূচনা।

মাইক্রোসফট ওয়ার্ড শিখুন।

হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল রাঃ এর জীবনী